ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের যত পদ্ধত


স্বাস্থ্যবার্তা

খবরটোয়েন্টিফোর.কম: জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বিকল্প নেইযুগের হাত ধরে বর্তমানে তাই ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের একাধিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছেআপনার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ব্যবহারবিধি, ঝুঁকি, মূল্য ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে বেছে নিতে পারেন এর যে কোনো একটি পদ্ধতি

আচরণগত পদ্ধতি
পূর্ণাঙ্গ দৈহিক মিলন থেকে বিরত থাকা এ পদ্ধতির অন্তর্গতআগেই উল্লেখ করা হয়েছে, কিছু ধর্মীয় গ্রুপ এ পদ্ধতি ব্যবহার করলেও বাস্তবতার নিরিখে এটা প্রায় অসম্ভবতবে নিয়ন্ত্রিত দৈহিক মিলন এ ক্ষেত্রে একটি চমকপ্রদ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারেএ পদ্ধতিতে বীর্যপাত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে যোনিপথ থেকে পুরুষাঙ্গ সরিয়ে নেয়াএতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন হয় নাফলে গর্ভ সঞ্চারের কোনো সুযোগও থাকে নাএ পদ্ধতিতে কোনো খরচ কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকলেও এর প্রধান সমস্যা হলো ১৯ ভাগ ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অকার্যকরঅর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ঝুঁকি অনেক বেশিতাছাড়া এ পদ্ধতিতে যৌনবাহিত রোগও প্রতিরোধ করা যায় না

প্রাকৃতিক ফ্যামিলি প্ল্যানিং
ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করা বেশ সুবিধাজনকতিনভাবে ন্যাচারাল ফ্যামিলি প্ল্যানিং করা যায়তার মধ্যে সেফ পিরিয়ড গণনা করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কাপলের জন্য বেশ আকর্ষণীয় মনে হতে পারেএ পদ্ধতিতে মহিলাদের পিরিয়ডের নিরাপদ সময় গণনা করা হয়

সাধারণত মাসিক শুরু হওয়ার আগের নয়দিন, মাসিকের দিনগুলো এবং মাসিক পরবর্তী চারদিন নিরাপদ সময়ের অন্তর্গতএ সময়ে দৈহিক মিলন হলেও গর্ভপাত সঞ্চারণের কোনো ঝুঁকি থাকে নাউল্লেখ্য, পিরিয়ডের সময় দৈহিক মিলন ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধতাছাড়া বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়সে কারণে মাসিক শুরুর আগের নয়দিন এবং মাসিক পরবর্তী চারদিনেই সেফ পিরিয়ড বা নিরাপদ সময় হিসেবে গণ্য করতে হবেঅঙ্কের হিসেবেও নিরাপদ সময় বের করা যায়ধরুন ২৮ দিন পরপর আপনার নিয়মিত মাসিক হয়২৮ থেকে প্রথমে ১৮ এবং পরে ১০ বাদ দিন (২৮-১৮=১০ এবং ২৮-১০=১৮)অর্থাৎ মাসিক শুরু হওয়ার দিন থেকে নবম দিন পর্যন্ত আপনি নিরাপদ, দশম দিন থেকে ১৮তম দিন পর্যন্ত আপনি ঝুঁকিপূর্ণ এবং আবার ১৯তম দিন থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত আপনি নিরাপদঅনেকের অনিয়মিত মাসিক হয়ধরুন কোনো মাসে ৪৫ দিন পর এবং অন্য মাসে ২৬ দিন পর হয়সে ক্ষেত্রে ৪৫ থেকে ১০ বাদ দিন (৪৫-১০=৩৫) এবং ২৬ থেকে ১৮ বাদ দিন (২৬-১৮=৮) অর্থাৎ মাসিক চক্রের অষ্টম দিন থেকে ৩৫তম দিন পর্যন্ত আপনি ঝুঁকির মধ্যে থাকবেনবাকি সময় মোটামুটি নিরাপদ

ন্যাচারাল
ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের উপকারিতা
এ পদ্ধতিতে হরমোন ট্যাবলেট বা কোনো ডিভাইস ব্যবহার করতে হয় নাকোনো কোনো ধর্মে এ জাতীয় জিনিস ব্যবহার করাও নিষিদ্ধতাই তাদের ক্ষেত্রে ন্যাচারাল ফ্যামিলি প্ল্যানিংই একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারেতাছাড়া যারা সন্তান নিতে চান তাদেরও নিরাপদ সময় ও ঝুঁকিপূর্ণ সময় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যককেননা একমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের দৈহিক সম্পর্ক আপনাকে পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্বের স্বাদ এনে দিতে পারে

ন্যাচারাল
ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের অসুবিধা

প্রায় ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যর্থ
যাদের অনিয়মিত মাসিক হয় তাদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না
এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে শিক্ষিত দম্পতি, কখনো কখনো ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে
যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধে অক্ষম

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি পদ্ধতিবহু বছর আগে থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের পিল ব্যবহৃত হয়ে আসছেতবে ওজন বৃদ্ধি, ব্রেস্টে ব্যথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে অনেকে পিল খেতে ভয় পানআশার কথা হলো, বর্তমানে ব্যবহৃত পিলে এসব সমস্যা হয় না বললেই চলে

পিল খাবারের পদ্ধতিটি মোটামুটি সবাই জানেএক পাতাতে সাধারণত ৩০টি পিল থাকেএর মধ্যে প্রথম ২১টিতে থাকে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নামক হরমোন এবং বাকি ৭টিতে কোনো হরমোন থাকে না, থাকে আয়রনপিল ডিম্বাণুর পরিস্ফুটনে বাধা দেয়ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে না

পিলের সুবিধাসমূহ
জন্মনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পিলের নানা সুবিধা রয়েছেযেমন-
অনিয়মিত পিরিয়ড নিয়মিতকরণে

বাড়তি পিল গ্রহণের মাধ্যমে আপনি পিরিয়ডবিহীন ছুটি কাটাতে পারেন অথবা রমজান মাসে টানা একমাস রোজা রাখতে পারেন

তলপেটের প্রদাহ, ব্রেস্টের কিছু রোগ, সিস্ট ইত্যাদি পিল গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়

ডিম্বাশয় ও ইউটেরাসের বিভিন্ন ক্যান্সার প্রতিরোধে পিল সহায়তা প্রদান করে

পিলের অসুবিধা

- বমি বমি ভাব
-
মাথাব্যথা
-
ব্রেস্টে ব্যথা
-
ওজন বৃদ্ধি
-
পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়া
-
পিরিয়ডবিহীন ব্লিডিং
-
বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন
-
টেনশন
-
সেক্সুয়াল আগ্রহ কমে যাওয়া
-
প্রতিদিন একই সময় খেতে হয়

বিশেষ কিছু ঝুঁকি
যেসব মহিলার রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি, যাদের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন আছে এবং যারা কিছুটা স্থুলকায়, তাদের ক্ষেত্রে খাবার পিল স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে

প্রমাণিত না হলেও ধারণা করা হয়, ব্রেস্ট ক্যান্সার কিংবা জরায়ু মুখের ক্যান্সার সৃষ্টিতে পিলের পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে

মিনি পিল
এ পিলে শুধু প্রোজেস্টেরন নামক হরমোন ব্যবহার করা হয়যেসব মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন তারা মিনি পিল ব্যবহার করতে পারেনএছাড়াও যারা ইস্ট্রোজেন সমৃদ্ধ পিল খেতে পারেন না, তারাও মিনি পিল খেতে পারেন

পিল খেতে ভুলে গেলে কী করবেন
একটি বা দুটি পিল খেতে ভুলে গেলে মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি পিল খাবেনএকই সঙ্গে সেদিনের নিয়মিত পিল যথাসময়ে খাবেনপরপর তিনদিন ভুলে গেলে জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্য কোনো পদ্ধতি যেমন-কনডম ব্যবহার করবেন এবং পিরিয়ড না হওয়া পর্যন্ত বাকি পিল খেয়ে যাবেন

ইনজেকশন
ইনজেকশনে এক ধরনের সিনথেটিক হরমোন ব্যবহার করা হয়বাণিজিক্যভাবে এটা ডিপো-প্রোভেরা নামে পরিচিতএকবার ইনজেকশন নিলে তিন মাস পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যায়

ইনজেকশনের সুবিধা

খুবই কার্যকর একটি পদ্ধতি
পিলের মতো এর ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই
ইউটেরাস ও ওভারির ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক
অনিয়মিত পিরিয়ড নিয়মিত করে

ইনজেকশনের অসুবিধা

প্রথম বছরে কিছু মহিলার পিরিয়ড নাও হতে পারে
ইনজেকশন বন্ধ করার পরও গর্ভধারণের জন্য কমপক্ষে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়
এছাড়া ওজন বৃদ্ধি, ডিপ্রেশন ইত্যাদি হতে পারে

কনডম
এটা খুবই কার্যকর একটা পদ্ধতিএকমাত্র কনডমের মাধ্যমেই যৌনরোগ প্রতিরোধ করা যায়বিয়ের প্রথম দিন থেকেই এটা ব্যবহার করা যায়ঠিকমতো না পড়লে এটা ফেটে যেতে পারে এবং একমাত্র তখনই এটা ব্যর্থ হতে পারেকনডমের সঙ্গে শুক্রাণুনাশী পদার্থ ব্যবহার করলে শতভাগ সফলতা পাওয়া যায়তবে অনুভূতি কিছুটা কমে যাওয়ায় অনেকে এটা ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না-ও করতে পারেন

জন্মনিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যৎ পদ্ধতি
জন্মনিয়ন্ত্রণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত এবং শতভাগ কার্যকর একটা পদ্ধতি আবিষকারের চেষ্টা দীর্ঘদিনেরতাছাড়া এ পর্যন্ত জন্ম নিয়ন্ত্রণের যত পদ্ধতি আবিষকৃত হয়েছে তার সবকিছুই মহিলাকেন্দ্রিকতাই খুব শিগগিরই বাজারে আসছে জন্মনিয়ন্ত্রণের বেশকিছু নতুন পদ্ধতি

পুরুষের জন্য পিল
গসিপল নামক এ পিল খুব শিগগিরই বাজারে আসছেএ পিলে স্টেরয়েড হরমোন থাকে, যা শুক্রাণুর ডেভেলপমেন্ট হতে দেয়া না

পুরুষের জন্য ইনজেকশন
এটা তিন মাস অন্তর ব্যবহার করতে হয়পুরুষদের যৌনাকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেয় বলে এটা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

যমুনা নিউজ : ‘ইমাম বুখারী’ কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের এক বিজয়ী সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহুল বুখারী বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তার সাধনার কাছে ঋণী। আসুন, খুব সংক্ষেপে আমরা এই মনিষীকে জানার চেষ্টা করি। নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ তিনি হচ্ছেন সমকালীন মুহাদ্দিছদের ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী। তাঁকে আমীরুল মুমিনীন ফীল হাদীছও বলা হয়। ১৯৪ হিঃ সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর রাত্রিতে তিনি বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশব কাল ও জ্ঞান অর্জনঃ শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন। শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন। তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর মাতা আল্লাহর কাছে খুব ক্রন্দন করলেন এবং স্বীয় সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত দেয়ার জন্য তাঁর কাছে অবিরাম দুআ করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক দিন তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে আল্লাহর নবী ইবরাহীম (আঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন তিনি প্রকৃত ঘটনা যাচাই করার জন্য স্বীয় সন্তানের কাছে গিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর সন্তান সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফেরত পেয়েছে। ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতাঃ ১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিছের নিকট তেকে হাদীছ সংগ্রহ করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্ত করে নিতেন। তাঁর জীবনীতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যখন বসরার মুহাদ্দিছদের হাদীছের ক্লাশে হাজীর হতেন তখন অন্যান্য ছাত্রগণ খাতা-কলম নিয়ে বসে উস্তাদের নিকট থেকে হাদীছ শুনতেন এবং প্রতিটি হাদীছই লিখে ফেলতেন। কিন্তু ইমাম বুখারী তা করতেন না। কয়েক দিন পর তাঁর সাথীগণ জিজ্ঞেস করলঃ আপনি শুধু আমাদের সাথে বসে থাকেন কেন? হাদীছগুলো না লেখার কারণই বা কি? এভাবে সময় নষ্ট করে লাভ কি? বন্ধুরা যখন পিড়াপিড়ি করতে থাকলো তখন ১৬ দিন পর তিনি বললেনঃ আপনারা আমার নিকট বারবার একই প্রশ্ন করছেন। আপনারা যে সমস্ত হাদীছ লিখেছেন তা আমাকে পড়ে শুনান। বন্ধুরা তা দেখানোর পর তিনি সমস্ত হাদীছ মুখস্ত শুনিয়ে দিলেন এবং আরও অতিরিক্ত পনের হাজার হাদীছ শুনালেন। অতঃপর তাঁর সাথীগণ তাদের কাছে রক্ষিত কিতাবের হাদীছগুলো ইমাম বুখারীর মুখস্ত কৃত হাদীছের সাথে মিলিয়ে ভুল-ভ্রান্তি ঠিক করে নিলেন। অতঃপর তিনি বন্ধুদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ এরপরও কি তোমরা বলবে যে, আমি এখানে অযথা সময় নষ্ট করছি? সে দিন থেকেই হাদীছ শাস্ত্রে তারা ইমাম বুখারীকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করলেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ যঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি। কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি। ইমাম বুখারীর বাল্যকালের একটি ঘটনা অত্যন্ত চমকপ্রদ। তখন তিনি দশ বছর বয়সের কিশোর। এ সময় তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ইমাম দাখিলীর ক্লাশে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করছিলেন। মুহাদ্দিছ দাখিলী এই সনদে একটি হাদীছ উপস্থাপন করলেনঃ سفيان عن أبي إبي الزبير عن إبراهيم “সুফিয়ান বর্ণনা করেন আবুয্ যুবাইর হতে আর আবুয যুবাইর বর্ণনা করেন ইবরাহমী হতে।” বালক বুখারী প্রতিবাদ করে বললেনঃ আবুয যুবাইর ইবরাহীম হতে হাদীছ হাদীছটি বর্ণনা করেন নি। মুহাদ্দিছ দাখিলী তাঁকে ধমক দিয়ে বললেও তিনি প্রশান্ত চিত্তে বললেনঃ أبو الزبير عن إبراهيم নয়: বরং زبير بن عدي عن إبراهيم আপনি দয়া করে একবার আপনার পান্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখুন। অতিরিক্ত জোর দেয়ার কারণে উস্তাদের মনে সংশয় দেখা দিল। তিনি পান্ডুলিপি দেখে ইমাম বুখারীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমার কথাই ঠিক। তখন মুহাদ্দিছ দাখিলী তার জন্য প্রাণ খুলে দুআ করলেন। হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণঃ হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর। বাগদাদে আগমণ ও তাঁর স্মরণ শক্তির পরীক্ষাঃ তৎকালীন সমগ্র ইসলামী রাজ্যে যখন মুহাদ্দিছ হিসেবে ইমাম বুখারীর কথা ছড়িয়ে পড়ল তখন সেই যুগের বড় বড় মুহাদ্দিছগণ তাঁকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাই তিনি যখন বাগদাদে আগমণ করলেন তখন চারশত মুহাদ্দিছ একত্রিত হয়ে ১০০টি সহীহ হাদীছ নির্বাচন করে তার সনদ ও মতন পাল্টিয়ে দিয়ে ১০ ভাগে বিভক্ত করে দশজন মুহাদ্দিছের হাতে সোপর্দ করলেন। অতঃপর তাঁর জন্য হাদীছের মজলিস স্থাপন করা হলো। তিনি যখন আসন গ্রহণ করলেন তখন প্রথমে একজন মুহাদ্দিছ ১০টি হাদীছ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি একটি করে সবগুলো হাদীছ পাঠ করে শেষ করলেন। প্রতিটি হাদীছ পড়া শেষ হলেই ইমাম বুখারী বলতেনঃ لاأعرفه অর্থাৎ এ ধরণের কোন হাদীছ আমার জানা নেই। এমনিভাবে ১০ জন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ১০০টি হাদীছ তাঁর সামনে পাঠ করলেন। সকল হাদীছের ক্ষেত্রেই তিনি বার বার একই কথা বললেন। পরিশেষে তিনি সকলকে ডেকে উলটপালট কৃত হাদীছগুলোর প্রত্যেকটি হাদীছকে তার আসল সনদের দিকে ফিরিয়ে দিলেন এবং ঠিক করে দিলেন। হাদীছগুলোর সনদ থেকে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েনি এবং মতনসমূহ থেকে একটি শব্দও ছুটে যায় নি। এমনকি হাদীছগুলো সঠিকভাবে সাজানোতে মুহাদ্দিছগণ তাঁর কোন ভুল-ত্র“টি ধরতে পারেন নি। বলা হয় যে, সমরকন্দে যাওয়ার পরও তাঁকে একই নিয়মে পরীক্ষা করা হয়েছিল। এতে সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসেবে সকলেই তাঁকে স্বীকৃত প্রদান করলেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণঃ ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। তিনি যাদের কাছে হাদীছ শুনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক বিন রাহওয়াই এবং আরও অনেকেই। তিনি আটবার বাগদাদে আগমণ করেছেন। প্রতিবারই তিনি আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন। প্রত্যেক সাক্ষাতের সময়ই ইমাম আহমাদ তাঁকে খোরাসান ছেড়ে দিয়ে বাগদাদে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। সহীহ বুখারী সংকলনের কারণঃ ইমাম বখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীছসমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও যঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম যঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন। তিনি তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতে এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেন যে, এক দিন আমি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইয়ের মসজিদে বসা ছিলাম। তিনি বললেনঃ তোমাদের কেউ যদি হাদীছের এমন একটি গ্রন্থ করতো, যাতে শুধু সহীহ হাদীছগুলোই স্থান পেতো তাহলে খুবই সুন্দর হতো। মজলিসে উপস্থিত সকলেই তাঁর কথা শুনলেও এ কাজে কেউ অগ্রসর হওয়ার সাহস পায় নি। ইসহাকের কথাগুলো ইমাম বুখারীর অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি সেই দিন হতেই এই মহান দায়িত্ব পালন করবেন বলে মনে মনে স্থির করলেন। তাঁর জীবনীতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীরে মাছি বসছে। তিনি এতে কষ্ট পাচ্ছেন। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানোয়াট হাদীছ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সহীহ হাদীছগুলো আলাদা করবে। আলেমদের ব্যাখা শুনে সহীহ হাদীছ সম্বলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। Jamunanews24.com/JA/ 9 Sept-2013. - See more at: http://jamunanews24.com/index.php/islam-view/39253-2013-09-09-12-08-27.html#sthash.UawvLnnF.dpufPopular Bangladeshi online newspaper jamunanews24.com , online newspaper and website design by pqsit.com