টিভি সাংবাদিক মানেই তারকা সাংবাদিক নন

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদকাঠামো ভেঙে নতুন একটি স্টাইল নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হয় একুশে। এ দেশের মানুষ সে স্টাইল গ্রহণ করে ভালোভাবে। আর সে চ্যানেলটির সাংবাদিকদের অনেকই হয়ে গেলেন তারকা বা স্টার। আরও ভালো করে বললে সংবাদ তারকা বা তারকা সাংবাদিক। এর আগে সিনেমার নায়কেরা, টিভি নাটকের অভিনেতারা কিংবা জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপকেরা তারকাখ্যাতি পেতেন। তাদের সঙ্গে যোগ হলেন টিভি রিপোর্টার, তারা হয়ে গেলেন এ দেশের মানুষের ড্রয়িং রুমের বাসিন্দা।
এ দেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতা শুরুর আগে সাংবাদিকেরা যে তারকাখ্যাতি পেতেন না, তা নয়। পত্রিকার অনেক জাঁদরেল সাংবাদিকের নাম ছড়িয়ে পড়ত, এখনো ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু সেই সাংবাদিককে দেশের অধিকাংশ মানুষই দেখতে পান না। ফলে পত্রিকার অক্ষর বেয়ে তিনি ঢুকে যান মানুষের মগজে এবং ভালো সাংবাদিকতা করলে মানুষের মনে। 
টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা। টেলিভিশন সাংবাদিক আসলে, তার দর্শকের পরিবারের সদস্য হয়ে যান। একটু ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। প্রিয় বন্ধুটি আমাদের পরিবারের কেউ নন। তার পরও সে বন্ধুটি পরিবারের সদস্যদের চেয়ে কম নয় কিছুতেই। এর কারণ তাকে আমরা প্রতিদিন দেখি। প্রতিদিন কথা বলি। তার পরামর্শ নিই। তাকে সহায়তা করি। সবচেয়ে বড় কথা, তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকে। একজন টেলিভিশন সাংবাদিকও তা-ই। তাকে দেখি প্রতিদিন ঘরের ড্রয়িং রুমে। তার কথা শুনি, কী ঘটছে তা তিনি আমাদের জানান। আর তার প্রতিটি কথাই আমরা বিশ্বাস করি। ফলে বাস্তবে দেখা না করেও একজন টেলিভিশন সাংবাদিক প্রতিদিন অসংখ্য ঘরে অসংখ্য পরিবারের অলিখিত সদস্য হয়ে যাচ্ছেন। তবে সিনেমার নায়ক দেখে যেমন আপ্লুত হয় ভক্তরা, ঠিক তেমনটি হয় না টিভি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে। দর্শক প্রতিক্রিয়ায় অবশ্যই একটু পার্থক্য থাকে। তাহলে কি স্টার বা তারকা হন না টিভি সাংবাদিকেরা। হন । তবে সবাই নন, কেউ কেউ। যারা তারকা হন, তারা হন নিজের কাজের গুণে। তারকা বা স্টারের সংজ্ঞা আসলে তা-ই। খুব ভালো বা অনবদ্য কাজের জন্য যখন একজন সবার প্রশংসা পান, তার মতো হতে সেই পেশার বা তার বাইরে অন্যরা চেষ্টা করেন, তখন তিনি তারকা বা স্টার হতে পারেন। টেলিভিশনের সব সাংবাদিকই কি নিজের কাজ দিয়ে সে জায়গাটি করে নিয়েছেন? তা নয় মোটেও। ফলে পেশায় সবাই পরিচিতি পান টিভিতে দেখা যায় বলে, কিন্তু তারকা সবাই হতে পারেন না। আইনজীবী, ডাক্তার বা ছাত্রদের মধ্যে যেমনি কেউ কেউ তারকা হন, এ পেশায়ও ঠিক তা-ই হয়। 
নতুন যারা টিভি সাংবাদিকতায় আসতে চান, বিশেষ করে তাদের এই অঙ্কটি মাথায় রাখা ভালো। তা না হলে অনেক দিন সাংবাদিকতার পর, অনেক পরিচিতি পাওয়ার পরও তারকা হতে না পারার মনঃকষ্ট কিন্তু থেকেই যেতে পারে। 
একটি টেলিভিশন তার স্বার্থেই নিজেদের সাংবাদিকদের পরিচিত করান ব্যাপকভাবে। কারণ দর্শক পরিচিত মুখের কাছে প্রয়োজনীয় কথাটি শুনে দ্রুত বিশ্বাস করে। প্রিয় বন্ধুটি যেসব কথা একজন মানুষকে প্রতিদিন বলে, তা কি কেউ ক্রস চেক করতে যায় কখনো? যায় না। ফলে একজন টেলিভিশন সাংবাদিককে টেলিভিশনে নানাভাবে দেখানো হলে সেটি টেলিভিশনেরই লাভ। আর পর্দায় উপস্থিতি টিভি সাংবাদিকের চাকরির অংশ। তার অধিকার। 
একজন সাংবাদিক কখন তারকা হয়ে ওঠেন? সে বিষয়ে সমকালের সাংবাদিক ওয়াকিল আহমেদ হিরণ বলেন, শেষ বিচারে পাঠক বা দর্শকই ঠিক করে দেয় কে তারকা হলেন, কে হতে পারলেন না। একজন রিপোর্টারের রিপোর্টে বা লেখায় কিছু ভুল হতেই পারে। বার্তা সম্পাদক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক সেটি ঠিক করে দেন। সে ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিকের তারকা হয়ে উঠতে বার্তাকক্ষের কর্তাব্যক্তিদেরও ভূমিকা আছে। সবাই যখন একজন বিনয়ী সাংবাদিককে তারকাখ্যাতি দেওয়া হয়, তা দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু যখন একজন সাংবাদিক নিজেকে তারকা মনে করে আচরণ পরিবর্তন করেন, তখন তা সেই সাংবাদিকের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। যা হোক, টেলিভিশন অবশ্য পুরোটাই টিমওয়ার্ক। ছবির জন্য একজন ক্যামেরাম্যানের প্রতি, ভিডিও সম্পাদনার জন্য ভিডিও সম্পাদকের প্রতি, সম্প্রচার কোয়ালিটি ঠিক রাখার জন্য প্রযোজক, প্রকৌশলীদের ওপর নির্ভর করতে হয় টিভি-সাংবাদিকদের। সবার প্রচেষ্টার পর একটি প্রতিবেদন দিনের সেরা প্রতিবেদন হয়ে ওঠে। কিংবা যে প্রতিবেদনটি সেরা প্রতিবেদন হলো না, সেটির জন্যও একই শ্রম বরাদ্দ রাখতে হয়। তারপরও একটি প্রতিবেদন দর্শক গ্রহণ নাও করতে পারেন। সেটি তার রুচিসম্মত নাও হতে পারে। 
টেলিভিশনের সাংবাদিকদের এ বিষয়টি সব সময় মাথায় রাখতে হয়। তারা কাজ করেন মানুষের রুচি নিয়ে। যিনি যত সহজে মানুষের রুচি বা চাহিদা ধরতে পারেন, তিনি তত দ্রুত ভালো সাংবাদিক থেকে তারকা সাংবাদিকে পরিণত হন। তাই বলে, একজন ভালো সাংবাদিক নিজের খেয়ালখুশিমতো চলেন, তা নয়। তাকেও বেশ কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। জনান্তিক থেকে প্রকাশিত টেলিভিশন সাংবাদিকতা বইয়ে নঈম তারিক লিখেছেন, একজন সাংবাদিককে সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়, থাকতে হয় জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত। ব্যক্তি সাংবাদিক পক্ষপাতমুক্ত না থাকলেও তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে পেশাদার শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয় তাকে। এ ছাড়া যাদের ক্ষমতা এবং অবস্থান জনগণকে প্রভাবিত করে তাদের পর্যবেক্ষণ করার অসাধারণ সামর্থ্য সাংবাদিকেরা রাখেন বলেও মনে করেন তিনি। জনগণকে সমালোচনা করার সুযোগ দেওয়া, উল্লেখযোগ্য বিষয়টিকে আগ্রহোদ্দীপক এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ করার কাজটি সাংবাদিককে করতে হয় যত্নের সঙ্গে। তার মতে, খবরকে একই সঙ্গে বিস্তারিত এবং পরিমিত রাখতে হবে। পক্ষপাতহীনতা, নির্ভুল তথ্য, কারও একান্ত জীবন ও ব্যক্তিগত বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো, রুচিবোধ আর ভদ্রতাকে টেলিভিশন সাংবাদিকতার কিছু মানদণ্ড হিসেবে ঠিক করেছেন তিনি।
যা হোক, বলা হচ্ছিল দর্শকের রুচি নিয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকদের বিষয়ে। টেলিভিশনের দর্শক হতে কোনো আলাদা যোগ্যতা লাগে না। কোনোভাবে একটি সেটের সামনে যেতে পারলেই হলো। সংবাদপত্র পড়তে হলে অন্তত পড়া শিখতে হয়। টেলিভিশনে ঠিক তা নয়। সংগত কারণেই টেলিভিশন একসঙ্গে অনেক বেশি মানুষের কাছে কাছে তথ্য নিয়ে যায়। তাই সেখানে রুচিবোধের তারতম্যও থাকে বেশি। সব মানুষের কথা বিবেচনা করে, প্রতিবেদনটি যে সাংবাদিক তৈরি করেন, তাকে বেশিসংখ্যক দর্শকদের গ্রহণ করার সম্ভাবনা। তাই বলে, সব প্রতিবেদনই একেবারে আপামর জনগণের জন্য করতে হবে তা নয়। চালের দাম বাড়ল, এ সংবাদটি যেমনি সব শ্রেণীর দর্শকের জন্য মনোযোগ টানবে, বাজেটে কত ঘাটতি হলো তা নিশ্চয়ই সব শ্রেণীর দর্শকের মনোযোগ টানবে না। টেলিভিশনে যেমনি নানা জনের নানা মত প্রকাশ পায়, তেমনি টেলিভিশন নীরবে নিভৃতে জাতীয় জনমত তৈরির কাজটিও করে যায়। কোনো একটি বিষয়ে যখন বিতর্ক চলে, তার নানা পক্ষের কথাই তুলে ধরেন সাংবাদিকেরা। আর তাতে দর্শকেরা নিজেরাই একটি সিদ্ধান্তে আসার তথ্য পেয়ে যান। এ ক্ষেত্রে যার প্রতিবেদন যত তথ্যভিত্তিক, যত গভীর হবে, ভালো সাংবাদিক থেকে তারকা সাংবাদিক হওয়ার পথে তিনি তত বেশি এগিয়ে যাবেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ মোস্তফা ফিরোজ বলেন, টেলিভিশনে চমৎকার টিমওয়ার্ক না হলে তারকা তৈরি হয় না। টিমে বিশৃঙ্খলা থাকলে বা গোটা টিমে চমৎকার বোঝাপড়া না থাকলে সে টিমে তারকা সাংবাদিক তৈরি হতে পারে না। একুশে টিভিতে চমৎকার টিমওয়ার্ক ছিল। ফলে সেখানে অনেক তারকা তৈরি হয়েছে। পরে চ্যানেল হয়েছে অনেক কিন্তু আশানুরূপ তারকা বের হয়নি। এ জন্য কিছুটা দায় অবশ্য ম্যানেজমেন্টকে নিতে হবে। টেলিভিশন বিজনেস আর দশটা বিজনেস থেকে আলাদা, তাই টেলিভিশন চালাতে হয় পেশাদার লোক দিয়ে। মোস্তফা ফিরোজ মনে করেন, একজন তারকা সাংবাদিক পুরো চ্যানেলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। তার উপস্থিতিতে মর্যাদার দিক থেকে, এমনকি বাণিজ্যিক দিক থেকেও উপকৃত হয় চ্যানেল। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে না পেরে অনেক চ্যানেলই সম্ভাবনা থাকার পরও, আলাদা করে তারকা সাংবাদিক তৈরি করতে পারছে না। যোগ্য ও একটু কম যোগ্য সাংবাদিক এক কাতারে মিলে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। একসময় বিটিভিতে অনেক তারকাশিল্পী তৈরি হয়েছে। কিন্তু দলীয়করণের কারণে, বিটিভি বেশ কয়েক বছর ধরে তারকা তৈরি করতে পারছে না বলেও মনে করেন বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ।
দর্শক কম কিন্তু তা টানতে বেশি প্রতিযোগিতার কারণে এখন অল্পসংখ্যক সাংবাদিক তারকাখ্যাতি পাচ্ছেন বলে মনে করেন বাংলাভিশনের সিনিয়র বার্তা সম্পাদক রুহুল আমিন রুশদ। টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচারের সুবিধা পাওয়ায় একুশে টিভি অনেক দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছে। তার ওপর বিটিভির গতানুগতিক একটা ধারা ভেঙে নতুন ধারা চালু করে মানুষের মনোযোগ টেনেছে চ্যানেলটি। একচেটিয়া মাঠে থাকায় একুশের প্রায় সব সাংবাদিকই তারকাখ্যাতি পেয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।
তবে সাংবাদিকতা করতে এসে তারকাখ্যাতি পেতে হবেÑএই ধারণার সমর্থক নন এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ. ই. মামুন। তিনি মনে করেন, সবার তারকা হওয়ার দরকারও নেই। শুরু হওয়ার পর একুশের সাংবাদিকদের তারকাখ্যাতি পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পথপ্রদর্শক হওয়ার কিছু সুবিধা থাকে। তখন যা দেখানো হয়েছে একুশে টিভিতে, সেটি নতুন মনে হয়েছে এবং দর্শকের ভালো লেগেছে। এ প্রসঙ্গে কিংবদন্তি ফুটবল খেলোয়াড় পেলের উদাহরণ টেনে জ. ই. মামুন বলেন, ‘তার সম্পর্কে আমরা বইয়ে পড়েছি, তার খেলা আমরা দেখিনি, কিন্তু তার পরও তাকে আমরা তারকা ফুটবলারের সম্মান দিই। ওই সময়ের অনেক প্রতিবেদনের চেয়ে এখন কেউ কেউ ভালো প্রতিবেদন করেন, কিন্তু পথপ্রদর্শকেরা (পাইওনিয়ার) যে ভালোবাসা পেয়েছেন, তা হয়তো তার জোটে না। তারকাখ্যাতি তিনি পান না। কিন্তু পরিশ্রমী সাংবাদিক, মানসম্মত সাংবাদিকতার জন্য ভালো সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি পান। নিজেকে টিভিতে শুধু দেখানোর আগ্রহ থেকে কেউ টিভি সাংবাদিকতায় আসবে, তাও সমর্থন করেন না জ. ই. মামুন। একজন চৌকস সাংবাদিককে সামনে এগিয়ে নিতে, তাকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে বলে মনে করেন এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ। এ ক্ষেত্রে পুরো নিউজরুমের সহায়তা লাগবে। সাংবাদিক ভালো প্রতিবেদন তৈরি করলেন, কিন্তু তা আলোর মুখ না দেখলে কোনো লাভ হলো না। আবার কাজের সুযোগ যেমনি দিতে হবে, তেমনি দায়িত্ব নিয়ে সে কাজটি ভালোভাবে করতে হবে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের। একটি আস্থার জায়গা তাকে তৈরি করতে হবে, যাতে তাকে যেকোনো কাজ দিতে নিউজরুমকে দুবার ভাবতে না হয়। এমনটিই মনে করেন জ. ই. মামুন। 
টেলিভিশন সাংবাদিকতাকে অনেকেই সশ্রম সাংবাদিকতা বলেন। তাদের সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হয়। অনেক চ্যানেলের ভিড়ে, নিজেকে আলাদা করতে মান ও পরিশ্রম আর জ্ঞান একজন সাংবাদিককে জ্বলজ্বলে তারকা বানানোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

যমুনা নিউজ : ‘ইমাম বুখারী’ কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। তিনি ইলমে হাদীসের এক বিজয়ী সম্রাট। তার সংকলিত হাদীসের মহামূল্যবান সংকলন সহীহুল বুখারী বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব মহা গ্রন্থ আল কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ তার সাধনার কাছে ঋণী। আসুন, খুব সংক্ষেপে আমরা এই মনিষীকে জানার চেষ্টা করি। নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ তিনি হচ্ছেন সমকালীন মুহাদ্দিছদের ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরা বিন বারদিযবাহ আলজু’ফী। তাঁকে আমীরুল মুমিনীন ফীল হাদীছও বলা হয়। ১৯৪ হিঃ সালের ১৩ই শাওয়াল জুমআর রাত্রিতে তিনি বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশব কাল ও জ্ঞান অর্জনঃ শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতার তত্বাবধানে তিনি প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন। শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীছ মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীছের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন। তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি ছোট থাকতেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর মাতা আল্লাহর কাছে খুব ক্রন্দন করলেন এবং স্বীয় সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত দেয়ার জন্য তাঁর কাছে অবিরাম দুআ করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক দিন তাঁর মা স্বপ্নে দেখলেন যে আল্লাহর নবী ইবরাহীম (আঃ) তাঁকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ ওহে! তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফেরত চেয়ে আল্লাহর দরবারে তোমার ক্রন্দনের কারণে তিনি তোমার সন্তানের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন তিনি প্রকৃত ঘটনা যাচাই করার জন্য স্বীয় সন্তানের কাছে গিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর সন্তান সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফেরত পেয়েছে। ইমাম বুখারীর স্মরণ শক্তির প্রখরতাঃ ১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীছের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিছের নিকট তেকে হাদীছ সংগ্রহ করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। আলেমগণ তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, যে কোন কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্ত করে নিতেন। তাঁর জীবনীতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যখন বসরার মুহাদ্দিছদের হাদীছের ক্লাশে হাজীর হতেন তখন অন্যান্য ছাত্রগণ খাতা-কলম নিয়ে বসে উস্তাদের নিকট থেকে হাদীছ শুনতেন এবং প্রতিটি হাদীছই লিখে ফেলতেন। কিন্তু ইমাম বুখারী তা করতেন না। কয়েক দিন পর তাঁর সাথীগণ জিজ্ঞেস করলঃ আপনি শুধু আমাদের সাথে বসে থাকেন কেন? হাদীছগুলো না লেখার কারণই বা কি? এভাবে সময় নষ্ট করে লাভ কি? বন্ধুরা যখন পিড়াপিড়ি করতে থাকলো তখন ১৬ দিন পর তিনি বললেনঃ আপনারা আমার নিকট বারবার একই প্রশ্ন করছেন। আপনারা যে সমস্ত হাদীছ লিখেছেন তা আমাকে পড়ে শুনান। বন্ধুরা তা দেখানোর পর তিনি সমস্ত হাদীছ মুখস্ত শুনিয়ে দিলেন এবং আরও অতিরিক্ত পনের হাজার হাদীছ শুনালেন। অতঃপর তাঁর সাথীগণ তাদের কাছে রক্ষিত কিতাবের হাদীছগুলো ইমাম বুখারীর মুখস্ত কৃত হাদীছের সাথে মিলিয়ে ভুল-ভ্রান্তি ঠিক করে নিলেন। অতঃপর তিনি বন্ধুদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ এরপরও কি তোমরা বলবে যে, আমি এখানে অযথা সময় নষ্ট করছি? সে দিন থেকেই হাদীছ শাস্ত্রে তারা ইমাম বুখারীকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করলেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীছ ও দুই লক্ষ যঈফ হাদীছ মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীছের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীছের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি। কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি। ইমাম বুখারীর বাল্যকালের একটি ঘটনা অত্যন্ত চমকপ্রদ। তখন তিনি দশ বছর বয়সের কিশোর। এ সময় তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ইমাম দাখিলীর ক্লাশে হাদীছের পাঠ গ্রহণ করছিলেন। মুহাদ্দিছ দাখিলী এই সনদে একটি হাদীছ উপস্থাপন করলেনঃ سفيان عن أبي إبي الزبير عن إبراهيم “সুফিয়ান বর্ণনা করেন আবুয্ যুবাইর হতে আর আবুয যুবাইর বর্ণনা করেন ইবরাহমী হতে।” বালক বুখারী প্রতিবাদ করে বললেনঃ আবুয যুবাইর ইবরাহীম হতে হাদীছ হাদীছটি বর্ণনা করেন নি। মুহাদ্দিছ দাখিলী তাঁকে ধমক দিয়ে বললেও তিনি প্রশান্ত চিত্তে বললেনঃ أبو الزبير عن إبراهيم নয়: বরং زبير بن عدي عن إبراهيم আপনি দয়া করে একবার আপনার পান্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখুন। অতিরিক্ত জোর দেয়ার কারণে উস্তাদের মনে সংশয় দেখা দিল। তিনি পান্ডুলিপি দেখে ইমাম বুখারীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমার কথাই ঠিক। তখন মুহাদ্দিছ দাখিলী তার জন্য প্রাণ খুলে দুআ করলেন। হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণঃ হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সে সময় যে সমস্ত দেশে বিজ্ঞ মুহাদ্দিছগণ বসবাস করতেন তার প্রায় সবগুলোতেই তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও তিনি যে সমস্ত দেশে ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মক্কা, মদীনা, ইরাক, হিজাজ, সিরিয়া, মিশর এবং আরও অনেক শহর। বাগদাদে আগমণ ও তাঁর স্মরণ শক্তির পরীক্ষাঃ তৎকালীন সমগ্র ইসলামী রাজ্যে যখন মুহাদ্দিছ হিসেবে ইমাম বুখারীর কথা ছড়িয়ে পড়ল তখন সেই যুগের বড় বড় মুহাদ্দিছগণ তাঁকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাই তিনি যখন বাগদাদে আগমণ করলেন তখন চারশত মুহাদ্দিছ একত্রিত হয়ে ১০০টি সহীহ হাদীছ নির্বাচন করে তার সনদ ও মতন পাল্টিয়ে দিয়ে ১০ ভাগে বিভক্ত করে দশজন মুহাদ্দিছের হাতে সোপর্দ করলেন। অতঃপর তাঁর জন্য হাদীছের মজলিস স্থাপন করা হলো। তিনি যখন আসন গ্রহণ করলেন তখন প্রথমে একজন মুহাদ্দিছ ১০টি হাদীছ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি একটি করে সবগুলো হাদীছ পাঠ করে শেষ করলেন। প্রতিটি হাদীছ পড়া শেষ হলেই ইমাম বুখারী বলতেনঃ لاأعرفه অর্থাৎ এ ধরণের কোন হাদীছ আমার জানা নেই। এমনিভাবে ১০ জন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ১০০টি হাদীছ তাঁর সামনে পাঠ করলেন। সকল হাদীছের ক্ষেত্রেই তিনি বার বার একই কথা বললেন। পরিশেষে তিনি সকলকে ডেকে উলটপালট কৃত হাদীছগুলোর প্রত্যেকটি হাদীছকে তার আসল সনদের দিকে ফিরিয়ে দিলেন এবং ঠিক করে দিলেন। হাদীছগুলোর সনদ থেকে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েনি এবং মতনসমূহ থেকে একটি শব্দও ছুটে যায় নি। এমনকি হাদীছগুলো সঠিকভাবে সাজানোতে মুহাদ্দিছগণ তাঁর কোন ভুল-ত্র“টি ধরতে পারেন নি। বলা হয় যে, সমরকন্দে যাওয়ার পরও তাঁকে একই নিয়মে পরীক্ষা করা হয়েছিল। এতে সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসেবে সকলেই তাঁকে স্বীকৃত প্রদান করলেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ ও ছাত্রগণঃ ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিছ সহীহ বখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ। তিনি যাদের কাছে হাদীছ শুনেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক বিন রাহওয়াই এবং আরও অনেকেই। তিনি আটবার বাগদাদে আগমণ করেছেন। প্রতিবারই তিনি আহমাদ বিন হাম্বালের সাথে দেখা করেছেন। প্রত্যেক সাক্ষাতের সময়ই ইমাম আহমাদ তাঁকে খোরাসান ছেড়ে দিয়ে বাগদাদে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। সহীহ বুখারী সংকলনের কারণঃ ইমাম বখারীর পূর্বে শুধু সহীহ হাদীছসমূহ একত্রিত করে কেউ কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। সহীহ বুখারী সংকলনের পূর্বে আলেমগণ সহীহ ও যঈফ হাদীছগুলোকে এক সাথেই লিখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম যঈফ হাদীছ থেকে সহীহ হাদীছগুলোকে আলাদা করে লেখার কাজে অগ্রসর হন। তিনি তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াই হতে এই মহৎ কাজের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তিনি স্বয়ং বর্ণনা করেন যে, এক দিন আমি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইয়ের মসজিদে বসা ছিলাম। তিনি বললেনঃ তোমাদের কেউ যদি হাদীছের এমন একটি গ্রন্থ করতো, যাতে শুধু সহীহ হাদীছগুলোই স্থান পেতো তাহলে খুবই সুন্দর হতো। মজলিসে উপস্থিত সকলেই তাঁর কথা শুনলেও এ কাজে কেউ অগ্রসর হওয়ার সাহস পায় নি। ইসহাকের কথাগুলো ইমাম বুখারীর অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি সেই দিন হতেই এই মহান দায়িত্ব পালন করবেন বলে মনে মনে স্থির করলেন। তাঁর জীবনীতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার স্বপ্নে দেখলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীরে মাছি বসছে। তিনি এতে কষ্ট পাচ্ছেন। আর ইমাম বুখারী হাতে পাখা নিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মাছিগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের সাথে যে সমস্ত জাল ও বানোয়াট হাদীছ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সহীহ হাদীছগুলো আলাদা করবে। আলেমদের ব্যাখা শুনে সহীহ হাদীছ সম্বলিত একটি কিতাব রচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। Jamunanews24.com/JA/ 9 Sept-2013. - See more at: http://jamunanews24.com/index.php/islam-view/39253-2013-09-09-12-08-27.html#sthash.UawvLnnF.dpufPopular Bangladeshi online newspaper jamunanews24.com , online newspaper and website design by pqsit.com